‘রাইস কয়েন’ ফাঁদে পা দিয়ে এক কোটি ২০ লাখ টাকা খুইয়েছেন সাবেক এক সংসদ সদস্য। বাস্তবে এ কয়েনের অস্তিত্ব না থাকলেও তিনি মনে করেন টাকা দিয়ে তিনি কয়েন পাননি। বনানী থানায় তিনি মামলা দায়েরের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তারা স্বীকার করেছে, এ কয়েনের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সাবেক এ এমপির বদ্ধমূল ধারণা ‘রাইস কয়েনের’ অস্তিত্ব রয়েছে। প্রতারকচক্র তার মস্তিষ্কে ‘রাইস কয়েনের’ বিষয়টি এমনভাবে ঢুকিয়েছে, তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না এটির অস্তিত্ব নেই।
এ চক্রের ফাঁদে পড়ে সচিব, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ কোটি কোটি টাকা খুইয়েছেন। সিআইডি এ ধরনের একাধিক চক্রকে আইনের আওতায় এনেছে। এর পরও তাদের প্রতারণা থামছে না। দুর্বল আইনের ফাঁক দিয়ে তারা গ্রেপ্তারের কিছু দিন পরই জামিনে বেরিয়ে আসছে। আবার চালিয়ে যাচ্ছে প্রতারণা।
শুধু ‘রাইস কয়েন’ প্রতারণাই নয়, বৈশ্বিক করোনা মহামারীতেও নানা কৌশলে সারাদেশে সক্রিয় দেশি-বিদেশি প্রতারক চক্র। নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে বিদেশি প্রতারক চক্রের সদস্যরাও হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। প্রতারকরা ইন্টারনেটভিত্তিক ডিজিটাল প্লাটফরমেও সক্রিয়। অনলাইনে বন্ধুত্ব তৈরি করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা প্রতারণাকে অনেকটা ‘শিল্পের’ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। প্রায় এক যুগ ধরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এ দেশে প্রতারণা করছে। চাকরির নামে প্রতারণা, বিকাশ প্রতারক চক্র, অনলাইনে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় কর্তা পরিচয়ে প্রতারণা, বিয়ের নামে প্রতারণা, বিদেশে লোক পাঠানোর নামে প্রতারণার কৌশলও বেশ পুরনো। এ ছাড়া মোবাইল ফোনে কল করে জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন প্রতারক চক্র।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রতারকরা এখন ডিজিটাল প্লাটফরমে সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। চলতি বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ৫ হাজারেরও বেশি প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। প্রতি বছর ৫০ হাজারের বেশি মানুষ প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারান। তাদের অধিকাংশই মধ্য ও নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ। এখন সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার হন চাকরিপ্রার্থীরা।
সম্প্রতি সিআইডি রাজধানীতে কয়েকটি অভিযান চালিয়ে অর্ধশত আফ্রিকানকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা বিভিন্ন ক্লাবে খেলার নামে, স্টুডেন্ট ভিসা এবং টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ছে। প্রতারণার ক্ষেত্রে সাধারণত দ-বিধির ৪২০ ধারায় মামলা হয়। এ মামলায় খুব সহজেই জামিন মেলে। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর। অর্থদ-ের বিধানও রয়েছে। কিন্তু এ আইন দিয়ে তাদের প্রতারণা ঠেকানো যাচ্ছে না।
করোনাকালেও থেমে ছিল না প্রতারণা। প্রতারক চক্র মহামারীর সুযোগে নতুন নতুন কৌশলে প্রতারণা করেছে। এমনকি করোনার ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া নিম্নমানের মাস্ক এবং পিপিই সরবরাহ নিয়ে প্রতারক চক্র সক্রিয় ছিল। মুমূর্ষু করোনা রোগীকে প্লাজমা দেওয়ার নাম করেও একাধিক চক্র সক্রিয় ছিল। নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়েও প্রতারকরা রমরমা ব্যবসা করেছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, প্রতারকরা নিত্যনতুন নানা কৌশলে প্রতারণা করছে। বাংলাদেশের মানুষ খুবই বিশ্বাসপ্রবণ। সরল বিশ্বাসে তারা প্রতারকদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। আরেকটি বিষয়, প্রতারণার শাস্তি আইনগতভাবে খুব কম। এ কারণেই প্রতারণা বিভিন্ন পর্যায়ে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক থাকতে হবে, সেটা দেশি বন্ধু হোক বা বিদেশি বন্ধু। অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রেও সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, দিনমজুর, গার্মেন্টসের কর্মচারী থেকে শুরু করে পুলিশের সিনিয়র অফিসার, শিক্ষক, বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার প্রতারণার ফাঁদে পা দেন, প্রতারিত হন। একটা পর্যায়ে তারা বেশ মরিয়া হয়ে প্রতারকদের কাছ থেকে অর্থ বা জিনিসগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করেন। তারা কোনো ধরনের মামলা মোকদ্দমা ছাড়াই এগুলো উদ্ধার করতে চান। প্রতারকরা খুবই স্মার্টলি প্রতারণা করে। প্রতারণাগুলো এত সূক্ষ্মভাবে করে, অনেক সময় বোঝার উপায় থাকে না। তা ছাড়া তারা টেকনোলজিও ভালো বোঝে।
তিনি আরও বলেন, যারা প্রতারিত হয়েছেন তাদের ভেতরে বড় ধরনের লোভ কাজ করে। তিন তাস খেলে অনেক টাকা উপার্জন করবেন এ লোভে এক ব্যক্তি তিন কোটি টাকার জমি দুই কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। তিনি অনেক টাকার মালিক। কিন্তু স্মাগলিং করে রাতারাতি লাভবান হবেন- এ ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। আবার দেশি-বিদেশি লোক বিপুল পরিমাণ অর্থ উপহার দেবে- এ ধরনের লোভেও অনেকে প্রতারিত হয়।
আইনের দুর্বলতার বিষয়ে তিনি বলেন, আইনে প্রতারণার শাস্তি কম। আইন যদি আরও কঠোর হতো, আইনের ধারা অজামিনযোগ্য হলে প্রতারণা কম হতো।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিসানুল হক বলেন, গত ৬ মাসে সিআইডি ২০০ জনেরও বেশি প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে বিদেশি প্রতারক অর্ধশতাধিক। তারা নানা কৌশলে প্রতারণা করে বিভিন্ন-শ্রেণিপেশার মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ধরনের চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে।
ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, প্রতারণার যে ধারা আছে, সেখানে সাজা বাড়ানো যেতে পারে। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মামলাগুলো প্রমাণ করাও জরুরি। অনেক সময় আপস-মীমাংসা করে ফেলে বাদী-বিবাদী পক্ষ।
তিনি আরও বলেন, কখনো কখনো প্রতারণা সিরিয়াস পর্যায়ে থাকে না। আবার কখনো কখনো দেখা যায় খুবই সিরিয়াস ধরনের হয়। যেমন যে প্রতারণায় রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে, সমাজের ক্ষতি হবে এ বিষয়ে আলাদা আইনি ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত। প্রতারণার বিষয়টি দুভাগে দেখতে হবে। একটি হলো রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা, আরেকটি হলো ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণা।
প্রতারণায় বিদেশিরা : বেশ কয়েক বছর ধরে বিদেশি প্রতারক চক্র বিশেষ করে আফ্রিকার কয়েকটি দেশের নাগরিকরা টুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বসবাস করছে। তারা বিদেশি নারীর ছবি দিয়ে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলছে। তার পর গিফট পাঠানোর নাম করে নানা কৌশলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। গত চার মাসে প্রায় অর্ধশত আফ্রিকানকে গ্রেপ্তারও করেছে সিআইডি। তাদের অধিকাংশই নাইজেরিয়ান। এ ছাড়া সোমালিয়া, ঘানা, কেনিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকরাও রয়েছে। অনেকে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলতে এসে প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ছে। খেলোয়াড় হিসেবে তাদের বাংলাদেশে আসার ভিসা দেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ভিসা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চাকরির নামে নানা কৌশলে প্রতারণা শিক্ষিত বেকারদের কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে শতশত প্রতারক চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ চক্রের ফাঁদে পড়ে অনেকেই প্রতারিত হচ্ছেন। বিশেষ করে ব্যাংক, বীমা, এমএলএম কোম্পানি, বিপণন কোম্পানি, মার্কেটিং কোম্পানির নামে বেশি প্রতারণা করা হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাসে, জনসমাগম হয় এমন স্থানে চাকরির আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এতে পার্ট টাইম চাকরির নামে ছাত্রছাত্রীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হয়। নিয়োগের নামে তাদের কাছ থেকে জামানত বা অন্যান্য খাতের অর্থ নিয়ে সটকে পড়ে। ভুয়া আউটসোর্সিং কোম্পানি খুলে চাকরির আশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গেও প্রতারণা করছে বিভিন্ন চক্র। সম্প্রতি সিআইডি এবং র্যাব এ ধরনের একাধিক চক্রকে আইনের আওতায় এনেছে।
প্রতারণায় ডিজিটাল কৌশল : ফেসবুকে সম্পর্ক তৈরি করে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে ব্ল্যাকমেইল করা, অশ্লীল লিংক ছড়িয়ে ব্যবহারকারীকে বিব্রত করা, কারও ফেসবুক বা ই-মেইল আইডি হ্যাক করে অর্থ দাবি করা, মোবাইলে লটারি জেতার কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আদায়সহ প্রতারক চক্র ডিজিটাল মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে। ওয়েবসাইট, নিউজ পোর্টাল তৈরি, আউটসোর্সিং, ইউটিউবে অ্যাকাউন্ট করে আয়ের প্রলোভন ও ফেসবুক লাইক বিক্রির নামেও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করেও অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র।
Leave a Reply